রাজেশ সাহা একজন শব্দসৈনিক।
সিনেমার পর্দার সামনের পেশা সম্বন্ধে মানুষ কম বেশি জানে। সাধারণ মানুষের জানার আগ্রহে তার প্রিয় সিনেমার নাম এবং অভিনয়শিল্পীর নাম পর্যন্তই। তবে একটি কাজের পেছনে থাকে একদল স্বপ্নবাজ মানুষ। একটি সিনেমা,নাটক অথবা ওয়েব সিরিজে কাজ করে অনেক মানুষ। কারো থাকে নিজের লালন করা গল্প,কারো থাকে ক্যামেরায় চোখ,কেউ আলোর প্রতিফলনে সহায়তা করে চিত্রগ্রহণে , কেউ দেয় নেতৃত্ব, আবার কেউ করে শব্দ নিয়ে খেলা।
সিনেমা জগতে যে ব্যাক্তি শব্দ নিয়ে খেলে তাকে "সাউন্ড ডিজাইনার" বলা হয়। অনেকে মনে করে শব্দ আর সঙ্গীত একই ব্যাপার এবং কাজটি সঙ্গীত পরিচালক করে ভেবে অনেকে গুলিয়ে ফেলেন।কিন্তু না, সঙ্গীত আর শব্দ একই জিনিস না। তবে আজকে আমাদের সাক্ষাতকারের প্রথম পর্বে আমরা কথা বলবো রাজেশ সাহা'র সাথে। যিনি একাধারে শব্দ গ্রাহক আবার সঙ্গীত পরিচালক।
রাজেশ সাহা'র শৈশবের বেশ সময় তিনি কাটান পঞ্চগড়ে। তারপর রাজশাহীতে কৈশোরকাল কাটান। গভ. ল্যাবরেটরী হাই স্কুলে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেন নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ, রাজশাহী থেকে। স্নাতক শেষ করেন ঢাকার ব্রাক ইউনিভার্সিটি থেকে এবং পরবর্তীতে ভারতের এ.এ.টি একাডেমি মুম্বাই থেকে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ফিল্ম অডিও পোস্ট-প্রোডাকশন নিয়ে পড়াশোনা করেন।
ডেইলি টাইমস নিউজ কথা বলে রাজেশ সাহা'র সাথে। কিছুক্ষণ চলে প্রশ্ন উত্তর।
ডেইলি টাইমস নিউজঃ শৈশবের একটা মূহুর্ত যা কখনো ভুলবেন না।
রাজেশ সাহাঃ রাজশাহীতে কলেজ ফাঁকি দিয়ে জেলামিলনায়তন এর সিঁড়িতে বসে বন্ধুরা মিলে গিটার নিয়ে গান-বাজনা, গল্প করতাম । কখনো পদ্মা নদীর তীরে বসে গান বাজনা করতাম ।
ডেইলি টাইমস নিউজঃ শব্দের প্রতি প্রথম ভালোবাসা কবে জন্মে?
রাজেশ সাহাঃ মা রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধনা করতো আর বাবা সিডি- ক্যাসেট জমাতো, বাড়িতে সব সময় গান বাজতেই থাকতো , তাছাড়া বন্ধু- বড় ভাইদের গিটার বাজানো দেখে গিটার হাতে নেই । সঙ্গীত এর জন্য ভালোবাসাটাই কখন যেন শব্দের প্রতি ভালোবাসাতে রূপ নিলো বুঝতেই পারিনি । এছাড়া ছোট বেলা থেকেই বাসায় কম্পিউটার থাকায় দোকান থেকে সিনেমা (সিডি) ভাড়া করে নিয়ে এসে কপি করে রেখে দেখতাম । বেশি দেখতাম অ্যাকশান সিনেমা । সেই সব ভালোলাগাই পরে এসে কাজে রূপ নেয় ।
ডেইলি টাইমস নিউজঃ সাউন্ড ডিজাইনার পেশাটি কিভাবে নেওয়া হয় এবং পরিবার কেমন সহযোগিতা করে?
রাজেশ সাহাঃ ব্র্যাকে পড়ার সময়ই শেষের দিকে এসে মনে হচ্ছিলো যা ভালবাসি তার থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি । আমি ভাবছিলাম এমন কিছু করতে যাতে মিউজিকটাকে কিছুটা হলেও ধরে রাখতে পারি । তখনি বাবা-মাকে বললাম । মা বলল বাবাকে বলতে। সত্যি বলতে আমার বাবা একজন সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা মানুষ আমি বিশ্বাস করি । তিনি আমার সাউন্ড নিয়ে পড়ার ইচ্ছা মেনে না নিলে আজকে আমার এই পেশায় থাকা হতো না । তারপর মুম্বাই শহরে পড়তে পড়তে পরিচিত হলাম ফিল্ম সাউন্ডের সাথে । বড় বড় কাজগুলো দেখতাম আর অবাক হতাম , এই অবাক হওয়াটাই ভালোবাসায় রূপ নিলো । তারপরতো এই বিষয়েও পড়াশোনা শুরু করলাম ।
ডেইলি টাইমস নিউজঃ সাউন্ড ডিজাইনার হিসেবে প্রথম কোন কাজটি করা হয় এবং অভিজ্ঞতা কেমন?
রাজেশ সাহাঃ মুম্বাই থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফেরার পর সাউন্ড ডিজাইনার হিসেবে আমার প্রথম কাজ হল “প্রজন্ম টকিজ” । আমার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু শাওকীর (তাকদীর) জন্য কাজটা পাই । তখন এই সিরিজটা বেশ সাড়া ফেলে দেয় ইন্ডাস্ট্রিতে । আমিও আস্তে আস্তে কাজ পেতে শুরু করি ।
ডেইলি টাইমস নিউজঃ আপনার উল্লেখ্যযোগ্য কিছু কাজের নাম, যা আপনার বর্তমান পরিচয় বহন করে।
রাজেশ সাহাঃ "প্রজন্ম টকিজ" এর পর অনেক কাজ করা হয়েছে, যার মধ্যে আছে অগণিত বিজ্ঞাপন । গত বছর সারা জাগানো “সোনার বাংলা সার্কাস " ব্যান্ডের গানের এ্যালবাম "হায়না এক্সপ্রেস” এর গানের মাঝের সাউন্ড ইফেক্টগুলো আমার করা । আমিও সাউন্ড টীমে ছিলাম এমন সারা জাগানো সিনেমার মধ্যে আছে দেবী(অনম বিশ্বাস) , ন ডরাই (তানিম অংশু), শনিবার বিকেল / Saturday Afternoon (মোস্তফা ফারুকী), ফাগুন হাওয়া(তৌকির আহমেদ), নোনা জলের কাব্য(রেজয়ান সুমিত) ইত্যাদি । ওয়েব সিরিজের মধ্যে আছে তাকদীর (শাওকী সাইদ) , কন্ট্রাক্ট (কৃষনেন্দু চট্টোপাধ্যায় ও তানিম নূর ) ।
ডেইলি টাইমস নিউজঃ তাকদীর এর সফলতার ছোয়া আপনার ক্যারিয়ারে কতটুকু গুরুত্ব রাখে?
রাজেশ সাহাঃ তাকদীরের সফলতা অবশ্যই আমার ক্যারিয়ারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অনেক খাটুনি গিয়েছে এই সিরিজের কাজ করতে গিয়ে। এমনকি কাজটা যাতে ভালভাবে হয় এজন্য ঐ সময়টায় অন্য সব কাজ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম । আমি বিশ্বাস করি ১০০ টা কাজের লোভ করার থেকে ১টা কাজ ভালো ভাবে করা উচিত । এতে কাজের মান বজায় থাকে , কাজের প্রতি সৎ থাকা যায় আর কাজটা করেও তৃপ্তি পাওয়া যায় ।
ডেইলি টাইমস নিউজঃ বর্তমান ব্যস্ততা কি নিয়ে যাচ্ছে?
রাজেশ সাহাঃ বর্তমানে রবিউল রবি ভাই এর ওয়েব সিরিজ বুদবুদ নিয়ে ব্যস্ত আছি । আমাদের সাউন্ড টীম (Studio Cowbell) কাজ করে যাচ্ছে । এটা খুব শীঘ্রই আমাদের দেশের OTT platform "চরকি" তে মুক্তি পেতে যাচ্ছে ।
ডেইলি টাইমস নিউজঃ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি ভাইয়া?
রাজেশ সাহাঃ আমার ইচ্ছা দেশের ফিল্ম অডিও পোস্ট প্রোডাকশন সেক্টরটাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যাতে বিদেশের বড় বড় ইন্ডাস্ট্রির ভালো ভালো কাজ আমরাও এখানে বসে করতে পারি । হলিউডের মত অনেক বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিই এখন বেশিরভাগ কাজই আউট সোর্স করে , এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও অনেক সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার আছেন যাদের প্রচুর বাহিরের কাজ করতে হয় । আমারও এরকম ইচ্ছা আছে । তাহলে অর্থনৈতিক দিক থেকেও দেশকে কিছু দিতে পারবো । এছাড়াও ইচ্ছা আছে যারা এই বিষয়ে পড়াশোনা করতে চায় তাঁদের জন্য ভবিষ্যতে দেশে একটা ইন্সটিটিউট খোলা ।
ডেইলি টাইমস নিউজঃ তরুণ প্রজন্ম এবং সিনেমাপ্রিয় মানুষেরা কিভাবে আসতে পারে এই পেশায়?
রাজেশ সাহাঃ তরুণ প্রজন্ম এবং সিনেমাপ্রিয় মানুষ যারা এই পেশায় আসতে চায় তাঁদের আমি বলবো যে ইচ্ছাটাকে যেভাবেই হোক বাঁচিয়ে রাখতে । কারণ ইচ্ছা থাকলে সব হয় । এখনো আমাদের দেশে এরকম বিষয়ে পড়াশোনা করার মতো ইন্সটিটিউট তৈরি হয়নি তাই পড়াশোনা করতে হলে বিদেশে গিয়ে পড়তে হয় । কিন্তু ইউটিউব এর মতো প্লাটফর্মের কারণে এখন নিজে নিজে অনেক কিছুই শিখে নেওয়া সম্ভব। এছাড়া বলব কথা কম বলার এবং প্রচুর শোনার অভ্যাস করতে হবে আর সেই সাথে ছোটবেলায় পড়া ফিজিক্স আর ম্যাথমেটিক্স ভুলে যাওয়া চলবে না । সাউন্ড এর সাথে ফিজিক্স অতঃপ্রোত ভাবে জড়িত , একটা ছেড়ে আরেকটা হয়না । আর সিনেমা চোখ দিয়ে দেখার সাথে সাথে কান দিয়ে শোনার অভ্যাসও করতে হবে । প্রথম থেকেই এটা মাথায় রাখতে হবে যে সিনেমার অর্ধেক হচ্ছে দেখা আর বাকি অর্ধেক শুনে অনুভব করা ।
ডেইলি টাইমস নিউজঃ ধন্যবাদ আপনাকে আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।
রাজেশ সাহাঃ ডেইলি টাইমস নিউজঃ কেও অনেক ধন্যবাদ এবং শুভকামনা।