কমল থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হওয়ার গল্প।

কমল থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হওয়ার গল্প।

জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার জন্ম ও শৈশবে ডাক নাম ছিলো কমল। পিতার নাম ছিল মনসুর রহমান এবং মাতার নাম ছিল জাহানারা খাতুন ওরফে রানী। তার পাঁচ ভাইদের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন দ্বিতীয়। এবং  পিতা কলকাতা শহরে এক সরকারি দপ্তরে রসায়নবিদ রূপে কর্মরত ছিলেন।  

শৈশবে তার কিছুকাল বগুড়ার গ্রামে ও কিছুকাল কলকাতা নগরীতে অতিবাহিত হয়। এবং ভারতবর্ষ বিভাগের পর তার পিতা পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি নগরীতে চলে যান। তখন জিয়া কলকাতার হেয়ার স্কুল ত্যাগ করেন এবং তিনি করাচি একাডেমি স্কুলে ভর্তি হন। ঐ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন তারপর ১৯৫৩ সালে করাচিতে ডি.জে. কলেজে ভর্তি হন। একই বছর তিনি কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার হিসেবে ক্যাডেট রূপে যোগদান করেন।

১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রূপে পদোন্নতি প্রাপ্ত হন। সামরিক বাহিনীতে একজন সুদক্ষ ছত্রসেনা ও কমান্ডো হিসেবে তিনি সুপরিচিতি লাভ করেন এবং স্পেশাল ইন্টেলিজেন্স কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি করাচিতে দুই বছর কর্মরত থাকার পর ১৯৫৭ সালে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে স্থানান্তরিত হয়ে আসেন। এবং ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে তিনি কাজ করেন।

১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর শহরের বালিকা খালেদা খানমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন জিয়াউর রহমান। ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে তাকে খেমকারান সেক্টরে তিনি অসীম বীরত্বের পরিচয় দেন। এবং এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য পাকিস্তান সরকার জিয়াউর রহমানকে হিলাল-ই-জুরাত খেতাবে ভূষিত করে ভারত।

১৯৬৬ সালে জিয়াউর রহমান পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে পেশাদার ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ লাভ করেন। সে বছরই জিয়াউর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটার স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে জিয়াউর রহমান মেজর পদে উন্নীত হয়ে জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন। এবং এডভান্সড মিলিটারি এন্ড কমান্ড ট্রেনিং কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তিনি পশ্চিম জার্মানিতে যান জিয়াউর রহমান কয়েক মাস ব্রিটিশ আর্মির সাথেও কাজ করেন।

১৯৭০ সালে একজন মেজর হিসেবে জিয়াউর রহমান দেশে ফিরে আসেন চট্টগ্রামে নবগঠিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন। এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর আক্রমণের পর তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে। এবং বিদ্রোহ করেন এবং ২৬শে মার্চ পরে ২৭শে মার্চ চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন জিয়াউর রহমান।

১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে প্রথমে তিনি ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন এবং চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, মিরসরাই, রামগড়, রাঙ্গামাটি, ফেনী প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন। 

জিয়াউর রহমান সেনা-ছাত্র-যুব সদস্যদের সংগঠিত করে পরবর্তীতে ১ম, ৩য় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই তিনটি ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রথম নিয়মিত সশস্ত্র ব্রিগেড জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন তিনি । ১৯৭১ সালের এপ্রিল হতে জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার তারপর জুন হতে অক্টোবর পর্যন্ত যুগপৎ ১১ নম্বর সেক্টরের ও জেড-ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের জন্য তাকে বীর উত্তম উপাধিতে হিসাবে ভূষিত করা হয়।

বাংলাদেশে সামরিক পেশাজীবন এবং স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানকে কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর ৪৪তম ব্রিগেডের কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। এবং  ব্রিগেডের সদস্যরা তারই অধীনে ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। ৭২ এর জুন মাসে তিনি কর্নেল পদে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ (উপ সেনাপ্রধান) নিযুক্ত করা হয় । ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে ঐ বছরের অক্টোবরে তিনি মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিযুক্ত করেন এবং নিজেও লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদবি গ্রহণ করেন জিয়াউর রহমান ।

১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে জিয়াউর রহমান  বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হতে অবসর গ্রহণ করেন। এবং শেখ মুজিব রহমান হত্যা ও পরবর্তী সময়

১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হবার ১০ দিন পর জিয়াউর রহমান  বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন ।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তখন খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এবং একই বছরের ২৫শে আগস্ট জিয়াউর রহমান চিফ অফ আর্মি স্টাফ নিযুক্ত করা হন। এবং ঐ বছরের ৩ নভেম্বর বীর বিক্রম শাফায়াত জামিল কর্নেল নেতৃত্বাধীন ঢাকা ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের সহায়তায় বীর উত্তম মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানা ঘটন। এর ফলে ৬ই নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমেদ পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হন এবং আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি  হয়।

এর পর জিয়াউর রহমানকে চিফ অফ আর্মি স্টাফ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এবং তার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখে যা সেনাবাহিনীর মধ্যে তার জনপ্রিয়তার কারণে তাকে অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।

সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় এবং জিয়াউর রহমানের প্রতি অবিচার করায় ক্ষুব্ধ সেনাসদস্যরা ৭ই নভেম্বর সিপাহী জনতা আরেক পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটায় এবং জিয়াকে তার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে ২য় ফিল্ড আর্টিলারির সদরদপ্তরে নিয়ে আসা হয় ।

ঐ দিন সকালেই পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়ায় শেরে বাংলা নগরে নিজ হাতে সে প্রতিষ্ঠিত ১০ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদরদপ্তরে ক্ষুব্ধ জোয়ানদের হাতে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম এবং কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম,  লেফটেনাল কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তম নিহত হয়। এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহি জনতা বিপ্লবের পর  রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। এবং ১৯শে নভেম্বর ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান পুনরায় সেনাবাহিনীর চিফ অফ আর্মি স্টাফ পদে নিযুক্ত করা হয়। উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয় জিয়াউর রহমান কে এবং ১৯৭৬ সালের ৮ই মার্চ মহিলা পুলিশ গঠন করেন তার পর ১৯৭৬ সালের ২৯শে নভেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। এবং তিনি ১৯৭৬ সালে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন। 

১৯৭৭ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি একুশে পদক প্রবর্তন করেন। তখন রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত সায়েমের উত্তরসূরি হিসেবে ২১শে এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ করেন। এবং ১৯৭৮ সালের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করে। এবং এই নির্বাচনে মোট ১০ জন ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী। উল্লেখ্য যে, এই নির্বাচনে ১১ জন প্রার্থী মনোনয়ন দাখিল করেন। ২ জনের বাছাই মনোনয়নপত্র এ বাদ পড়ায় বৈধভাবে মনোনীত প্রার্থীর সংখ্যা দারায় ৯ জন। ১ জন আপিল দাখিল করায় ও তার আপিল গৃহীত হওয়ায়   

কারনে কোন প্রার্থী প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করায় সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা দারায় ১০ জন । এরপর জিয়াউর রহমান মে মাসে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা ও আস্থা যাচাইয়ের জন্য ৩০শে মে গণভোট অনুষ্ঠান ও হ্যাঁ-সূচক  বিপুল ভোট জনসমর্থন লাভ করেন। এবং ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী (বিএনপি) দল গঠন করেন। 

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এই দলের সমন্বয়ক ছিলেন এই দলের প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক এ. কিউ. এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছিলেন প্রথম মহাসচিব। এবং ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টায় রমনা রেস্তোরাঁয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ভাবে  ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যাত্রা শুরু করেন। এবং সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি প্রথমে ১৮ জন সদস্যদের নাম তারপর ১৯শে সেপ্টেম্বর ওই ১৮ জনসহ ৭৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি  আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। এবং বিএনপি গঠন করার আগে ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল  (জাগদল) নামে একটি দল উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার সভাপতি করে দল গঠিত হয়েছিল। 

২৮শে আগস্ট ১৯৭৮ সালে নতুন একটি দল গঠন করার লক্ষ্যে জাগদলের বর্ধিত সভায় ওই দলটি বিলুপ্ত ঘোষণার মাধ্যমে দলের এর অঙ্গ সংগঠনের সকল সদস্যদেকে জিয়াউর রহমান ঘোষিত নতুন দলে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এবং তিনি রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবং এ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২০৭টিতে জয়লাভ করেন। এবং নির্বাচনে অংশ নিয়ে আব্দুল মালেক উকিল এর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩৯টি এবং মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২টি আসনে জয়লাভ করে। এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ৮টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ১টি ও মুসলিম ডেমোক্রেটিক লীগ ২০টি আসনে জয়লাভ করে। 

জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ২৯শে মে চট্টগ্রামে আসেন সার্কিট হাউসে রাতে থাকেন। মেজর মোজাফফর ও ক্যাপ্টেন মোসলেহ উদ্দিন সর্বপ্রথম জিয়াউর রহমান কে খুঁজে পান। এবং মোসলেহ উদ্দিন জিয়াকে জানান যে, তাকে তাদের সাথে সেনানিবাসে যেতে হবে। এবং কর্নেল মতিউর রহমান আরেকটি দল নিয়ে উপস্থিত হন তারপর জিয়াউর রহমান কে ৩০শে মে গভীর রাতে অনেক কাছ থেকে একটি এসএমজি দিয়ে গুলি করে হত্যা করেন।