দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর ১২৪ তম জন্মজয়ন্তী আজ।
প্রেম, বিরহ-বেদনা ও সাম্যবাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বাংলা সাহিত্য-সংগীত তথা সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণ পুরুষ ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার হ্মুরধার লেখনী ধূমকেতুর মতো আঘাত হেনে গোটা ভারতবর্ষের আপামর জনতার ঘুমন্ত সত্তাকে জাগিয়ে দিয়েছিল। তিনি গোটা জাতির জন্য ছিলেন বিধাতার আশির্বাদ স্বরূপ।সারাটি জীবন সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, অন্যায়-অত্যাচার, বৈষম্য, শোষণ ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে অগ্নিকণ্ঠে সোচ্চার হয়ে কবি লিখে গেছেন অসংখ্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গান।
জাতীয় পর্যায়ে কবি নজরুলের জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে প্রতিবছর ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এ বছর কোভিড-১৯ এর প্যানডেমিক সিচুয়েশনের কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে তেমনভাবে থাকছে না কোন আয়োজন। তবে তার জন্মদিন উপলক্ষে আজ (সোমবার) থেকে দুই দিনব্যাপী ‘আমিই নজরুল আর্ন্তজাতিক নজরুল উৎসব’ আরম্ভ হয়েছে। বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২২তম জয়ন্তী উপলক্ষ্যে ‘কবি স্মরণ’-এর আয়োজন করেছে।দেশের বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী টিভি চ্যানেল ও রেডিও এবং ফেসবুক পেজ এ সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।
বিদ্রোহী নজরুল তার ৭৭ বছরের জীবনকালের ৩৪ বছরই ছিলেন নির্বাক (১৯৪২-১৯৭৬)। বেঁচে থাকার জীবন সংগ্রাম, অভাব-অনটন, নানা প্রতিকূলতা, জেলজুলুমের মধ্যেই কাটে তার জীবনের সিংভাগ সময়। সবমিলিয়ে সাহিত্যচর্চার সময় পেয়েছিলেন মাত্র ২৪ বছর (১৯১৯-১৯৪২)। কিন্তু মাত্র এই ২৪ বছরে নজরুল রেখে গেছেন এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত। সৃষ্টি করে গেছেন ২২টি কাব্যগ্রন্থ, সাড়ে ৩ হাজার, মতান্তরে ৭ হাজার গানসহ,৭টি চলচ্চিত্র কাহিনীসহ অসংখ্য কালজয়ী গ্রন্থ ও রচনাবলী। তাই তো একাধারে তিনি কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, শিশু সাহিত্যিক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, গীতিকার, সুরকার, গীতিনাট্যকার, সঙ্গীত পরিচালক, গায়ক, বাদক, সঙ্গীতজ্ঞ ও অভিনেতা ইত্যাদি বহু নামে পরিচিত।
তিনিই প্রথম বাঙালি কবি যিনি পূর্ণাঙ্গভাবে ভারতের স্বাধীনতা দাবি করেছিলেন। এ বিষয়ে তার কণ্ঠের দৃঢ়তা ও চেতনায় বলিষ্ঠতা প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বময়।
সেই বিশের দশকে কুড়ি বছরের তরুণের মনের ভেতরকার সেই যে বিদ্রোহ, পরাধীনতা, গ্লানি, ক্ষোভ, দ্রোহ তারই বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়, যা তখনকার ক্ষুব্ধ প্রতিটি বাঙালির কলিজায় আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল। এসব কারণে ইংরেজ সরকার তার বিভিন্ন গ্রন্থ ও রচনা বাজেয়াপ্ত করেছে এবং কারাদণ্ডও দিয়েছে। কারাগারেও বিদ্রোহী নজরুল বিদেশী সরকারের তাবেদারীর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
আর পরবর্তীকালে তা স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণা হিসেবে দেখা দেয়। শত প্রতিকূলতা, শত বিরোধিতা, শত সমালোচনা, নিরুৎসাহ, ভর্ৎসনা, প্রতিবন্ধকতা কোনো কিছুতেই নজরুলের প্রতিভাকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। এ অবস্থায় নজরুলের বিস্ময়কর প্রতিভা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন ওই সময় প্রথম বাঙালি নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই তো আশীর্বাণী দিয়ে তিনি কবিকে বলেছিলেন, ‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু’।
১৯৪১ সালের শেষের দিকে কবি যখন নন্দিনী চলচ্চিত্রের সংগীত রচনা ও সুরারোপের সময় তখন হঠাৎ তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে কবিকে পাঠানো হয় ইংল্যান্ড ও জার্মানিতে। কিন্তু ততদিনে সবই শেষ। বাকশক্তি একেবারেই হারিয়ে ফেলেন তিনি। সেই ১৯৫৩ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় অনেকটা নীরবতাকে সংগী করেই কলকাতাতে কাটে কবি নজরুলের জীবন। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবির জন্মদিনে তাকে ঢাকায় নিয়ে এসে জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করেন এবং কাজী নজরুল ইসলামের র রচিত বিখ্যাত কবিতা ‘চল্ চল্ চল্- কে সামরিক সংগীত হিসেবে নির্বাচিত করে কবিকে সম্মানিত করেন।
১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তৎকালীন পিজি (বর্তমানে বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সব ভক্তদের দুঃখের স্রোতে ভাসিয়ে তিনি পরপাড়ে পথে পাড়ি জমান।
ভক্তকূলেরা আজো তাকে খুঁজে ফেরে কিন্তু তার দেখা যে মেলেনা তিনি আছেন, তিনি তার সৃষ্টির মাঝেই বেঁচে থাকবেন সর্বত্রজুড়ে "